ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের এক শিক্ষার্থী পুরো কোরআন শরীফ হাতে লিখে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। দীর্ঘ দেড় বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় তিনি এ কাজটি শেষ করেছেন। কোন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না পড়েই পবিত্র কোরআন লেখার মতো এ কঠিন কাজের জন্য রীতিমতো প্রশংসায় ভাসছেন ওই তরুণী। হাতে কোরআন লেখা ওই তরুণীর নাম জারিন তাসনিম দিয়া। তিনি বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য। তাঁর বাড়ি জামালপুর জেলায়।
জানা যায়, লকডাউনে ঘরে বসে নিজের অবসর সময় পার করতে বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন হাতে লিখা শুরু করেন। বিরামহীন অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের পর অবশেষে দীর্ঘ দেড় বছর পর মোট ৩০ পারার এক এক করে ১১৪টি সুরা লিখে শেষ করেন দিয়া। ২০২০ সালের মার্চ মাসে শুরু করে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে তার এ কাজটি শেষ হয়।
তিনি জানান, একদিন তাঁর বাবা ঘরে টানিয়ে রাখার জন্য তাকে যেকোনো একটি দোয়া লিখে দিতে বললে তিনি জীবনের প্রথমবারের মতো দেখে দেখে কোরআনের অংশবিশেষ (আয়াতুল কুরসী) লিখেন। তার এ লেখা দেখতে সুন্দর হওয়ায় তার বাবা ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং পুরো কোরআনই লেখার অনুপ্রেরণা জোগান। এছাড়া তারও ইচ্ছা ছিল করোনা মহামারিতে লকডাউনে ঘরে আবদ্ধ থাকার সময়টুকুকে কাজে লাগিয়ে সৃজনশীল কিছু করা যায় কি না। এই দুটি বিষয়কে মাথায় রেখেই শুরু হয়ে যায় পুরো কোরআন হাতে লেখার কঠিন এ কাজটি সম্পন্ন করার সংগ্রাম।
জানা যায়, কোরআন লেখার পুরো দেড় বছরই সব সময় তার ব্যাগে লেখার উপকরণ রেখেছেন। যখনই সুযোগ পেতেন তখনই কোরআন লিখতেন দিয়া। তিনি ঢাকা থেকে যখন গ্রামের বাড়ি যেতেন তখনও লেখার এসব উপকরণ সাথে নিয়ে যেতেন, যাতে তার লেখা বন্ধ না থাকে। লেখা শেষে তিনি পাণ্ডুলিপির মোট ৩০ পারাই ৩০ জন হাফেজকে দিয়ে সম্পাদনা করিয়েছেন। অবশেষে ৩০ জন হাফেজের সম্পাদনা শেষে তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো বাঁধাই করে রুপ দেওয়া হয়েছে পূর্ণাঙ্গ কোরআন শরীফে। এখন দেশের ৫০০ মডেল মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে তিনি তার নিজ হাতে লিখিত এ কোরআন শরীফের একটি করে কপি মুসল্লি ও মাদ্রাসার ছাত্রদের পড়ার জন্য উপহার দিতে চান।
এ বিষয়ে জারিন তাসনিম বলেন, ‘করোনা মহামারিতে যখন আমরা ঘরবন্দি ছিলাম, তখন আমার এরকম একটা ইচ্ছা ছিল যে আমি সৃজনশীল কিছু করব। সেই চিন্তা থেকেই আমার এই হাতে কোরআন লেখার কাজটা শুরু করা। বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় মূলত এ কাজটা শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে, বাবা আমাকে সর্বপ্রথম উৎসাহ প্রদান করেছেন।’
আরবি লেখা শেখার ব্যাপারে দিয়া বলেন, ‘আমি মাদ্রাসার ছাত্রী না আবার কখনো মাদ্রাসায়ও পড়িনি। এজন্য ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও আমার খুব একটা আইডিয়া ছিল না। ছোটবেলায় আমরা ইসলাম ধর্ম বই পড়তাম তখন একটু একটু আরবি শব্দাবলী দেখে দেখে লেখার চেষ্টা করতাম। তাছাড়া আমার আর কখনো আরবি লেখার প্র্যাকটিসটা করা হয়নি। তবে বাবা-মা ছোটবেলায় কোরআন শরীফ পড়তে শিখিয়েছিলেন সে হিসেবে আমি পড়তে পারি কিন্তু তা লিখতে পারতাম না কখনো। আমার আরবি লেখা শেখাই হলো এই করোনা মহামারিতে।’
তিনি পুরো কোরআন লেখা শুরুর বিষয়ে বলেন, ‘একদিন আমার বাবা দেয়ালে টানানোর জন্য একটি দোয়া লিখে দিতে বলেছিলেন। তখন আমি দেখে দেখে আয়াতুল কুরসি লিখে দিয়েছিলাম এবং লেখাটা খুব ভালো হয়েছিল। লেখা দেখে বাবাও খুশি হয়েছিলেন। এরপর বাবা-মায়ের অনুপ্রেরণায় লেখা শিখতে শুরু করলাম। আরবি গুলো আয়ত্ত করে, আস্তে আস্তে প্র্যাকটিস করতে থাকলাম। এভাবে লিখতে লিখতে ৫ পারা, ১০ পারা এরপর পুরো কোরআনের ৩০টা পারাই হাতে লিখে শেষ করে ফেললাম। লেখা শেষ করে আমি পেইজগুলো একটু ডিজাইন করলাম। সকল পেইজের ডিজাইন আমার হাতেই করা।’
দিয়া আরও বলেন, ‘লেখা শেষ হওয়ার পর আরেকটি কাজ বাকি ছিল। সেটি হল সম্পাদনার কাজ। কারণ, এখানে ভুল হওয়ার ব্যাপার আছে। পবিত্র কোরআন শরীফের একটা শব্দও যেন ভুল না হয়, সেই জিনিসটা মেইনটেইন করতে হবে। আমি তো আর কোরআনের হাফেজ না, এজন্য আমার দ্বারা ভুল ধরা সম্ভব নয়। এ প্রেক্ষিতে ভুলগুলো সংশোধনের জন্য আমি কোরআনের হাফেজদের সাথে পরামর্শ করলাম। তখন তারা বললেন যে, এটা আসলে একজনে চেক করলে হবে না। কারণ চোখের ভুল সবারই হতে পারে। তারা বললেন, আমরা এর ৩০ পারা ৩০ জনকে দিয়ে চেক করাবো। এভাবে একেক পারা শেষ করে একেকজন অন্য পারা ধরবে। এভাবে করে ৩০ জন হাফেজ ৩০ পারাই দেখবে। তাহলে ভুলগুলো আমরা সহজেই ধরতে পারব। এই পদ্ধতিটা অনুসরণ করেই তারা পাণ্ডুলিপির ভুলগুলো ধরে মার্ক করে দিলেন। তারপর আমি সেগুলো সংশোধন করলাম। এই সংশোধন করার পর আমি আবার তাদেরকে পাণ্ডুলিপিটি দেখার জন্য দিলাম। এরপর তাদের কাছে এটি দুই বা আড়াই মাসের মতো সম্পাদনায় ছিল।
অবশেষে, তাদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপিটি এনে স্ক্যানিং করে ছাপিয়ে বাঁধাই করেছি।’
হস্তলিখিত কোরআন ছাপানোর ব্যাপারে দিয়া বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে ৫০ কপি ছাপিয়েছি। এই ৫০ কপির মধ্য থেকে আমার আত্মীয়-স্বজন এবং কাছের মানুষদেরকে উপহার দিব। আর তাছাড়াও আরও ৫০০ কপি ছাপানো হচ্ছে বিভিন্ন মডেল মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে বিনামূল্যে উপহার দেওয়ার জন্য, যাতে সবাই পড়তে পারে। এর বাইরে যদি ব্যক্তিগতভাবে নিতে চায় তাহলে বাঁধাইয়ের খরচটুকু দিয়ে নিতে পারবেন।’
হাতে কোরআন লেখার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে দিয়া বলেন, ‘এ কাজটি আমার জীবনের সেরা একটি অর্জন। মানুষের জীবন তো খুব বড় নয়। আমি না থাকলেও আমার এ কাজের জন্য মানুষ হয়তো আমাকে মনে রাখবে।’